আরবদের সিন্ধু এবং মুলতান বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞলের অবস্থা।
(Condition of North-Western India at the eve of Arab conquest of Sindh and Multan)
রাজনৈতিক অবস্থা (Political Conditions)
আরব মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে কোনাে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে জানা
যায় যে, মৌর্য সম্রাট মহারাজ অশােক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম য়েছিলেন।
রাজনৈতিক অবস্থা (Political Conditions)
আরব মুসলমানদের বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে কোনাে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে জানা
যায় যে, মৌর্য সম্রাট মহারাজ অশােক (২৭৩-২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম য়েছিলেন।
কিন্তু ২৩২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যুর পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে। কোনাে হিন্দু রাজা বা রাজনৈতিক নেতা এমনকি সমুদ্রগুপ্ত (সম্ভবত ৩৩০–৩৮১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের (৩৮১–৪১৩
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মতাে খ্যাতিমান শাসকেরাও সমগ্র উপমহাদেশকে নিজেদের শাসনভুক্ত করতে পারেননি। সপ্তম শতকে
সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক
চালুক্য রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী সমগ্র দাক্ষিণাত্য মালভূমির ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মতাে খ্যাতিমান শাসকেরাও সমগ্র উপমহাদেশকে নিজেদের শাসনভুক্ত করতে পারেননি। সপ্তম শতকে
সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক
চালুক্য রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী সমগ্র দাক্ষিণাত্য মালভূমির ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
কিন্তু এ দুই মহান সম্রাটের মৃত্যুর পর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য ভেঙে পড়ে। যােগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে তাদের সাম্রাজ্য ছিন্ন- ভিন্ন হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষে অনেকগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
এ সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে ছিল
আফগানিস্তান, কাশ্মির, কনৌজ, দিল্লি ও আজমির, সিধু, মালব, গুজরাট, বুন্দেলখণ্ড, নেপাল, আসাম, বাংলা প্রভৃতি
একে অন্যের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলাে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায়
রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ভি. ডি, মহাজনের (V.D Mahajan) মতে, “রাজনৈতিক
ক্ষেত্রে দেশে কোনাে সার্বভৌম কর্তৃত্ব ছিল না। ভারতবর্ষ ছিল রাষ্ট্রগ্রন্থী, যার প্রতিটি রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিল ।”
আফগানিস্তান, কাশ্মির, কনৌজ, দিল্লি ও আজমির, সিধু, মালব, গুজরাট, বুন্দেলখণ্ড, নেপাল, আসাম, বাংলা প্রভৃতি
একে অন্যের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলাে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায়
রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়ে যায়। ঐতিহাসিক ভি. ডি, মহাজনের (V.D Mahajan) মতে, “রাজনৈতিক
ক্ষেত্রে দেশে কোনাে সার্বভৌম কর্তৃত্ব ছিল না। ভারতবর্ষ ছিল রাষ্ট্রগ্রন্থী, যার প্রতিটি রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিল ।”
ফলে কেন্দ্রীয় কোনাে শক্তি না থাকায় এসব রাজ্যে অনৈক্য ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় থাকায় আরব মুসলমানগণ
যখন সিন্ধু বিজয়ে অগ্রসর হয় তখন তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা একটি সংহত ও সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ।
প্রশাসনিক অবস্থা (Administrative Conditions)
আরব বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রাচীন বৌদ্ধ যুগের প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে বংশানুক্রমিক রাজা নিযুক্তির প্রথা চালু হয়। অবশ্য রাষ্ট্রের সংকটজনক অবস্থায় কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে রাজ্যে অভিজাতশ্রেণি রাজা নিয়ােগ করতেন। কোথাও কোথাও সিংহাসনে নারী অধিকার স্বীকার করে নেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ।
ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে রাজা আইন
প্রণয়ন, শাসনকাজ পরিচালনা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। রাজকার্য পরিচালনায়
মন্ত্রিজ' এবং 'সচিব' নামক দু'শ্রেণির মন্ত্রী রাজাকে সহায়তা করতেন।
প্রণয়ন, শাসনকাজ পরিচালনা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। রাজকার্য পরিচালনায়
মন্ত্রিজ' এবং 'সচিব' নামক দু'শ্রেণির মন্ত্রী রাজাকে সহায়তা করতেন।
উপরিক’ পদবিধারী শাসনকর্তা প্রাদেশিক শাসন
পরিচালনা করতেন । উত্তর ভারতে প্রদেশকে বলা হতাে ‘ভূক্তি' এবং দক্ষিণ ভারতে ‘মণ্ডল’ । রাষ্ট্র এবং ‘দেশা' নামেও
কোথাও কোথাও প্রদেশগুলাে পরিচিত ছিল। বিষয় বা জেলার প্রধান কর্মকর্তার পদবি ছিল ‘বিষয়পতি'। শাসনব্যবস্থার
সর্বনিম্নস্তর ছিল ‘গ্রাম’।
পরিচালনা করতেন । উত্তর ভারতে প্রদেশকে বলা হতাে ‘ভূক্তি' এবং দক্ষিণ ভারতে ‘মণ্ডল’ । রাষ্ট্র এবং ‘দেশা' নামেও
কোথাও কোথাও প্রদেশগুলাে পরিচিত ছিল। বিষয় বা জেলার প্রধান কর্মকর্তার পদবি ছিল ‘বিষয়পতি'। শাসনব্যবস্থার
সর্বনিম্নস্তর ছিল ‘গ্রাম’।
পায়েত কর্তৃক গ্রামের শাসন পরিচালিত হতাে ।
অর্থনৈতিক অবস্থা (Economic Conditions)
প্রাচীনকাল থেকেই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্যের জন্য ভারতবর্ষের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল ।
অর্থনৈতিক অবস্থা (Economic Conditions)
প্রাচীনকাল থেকেই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্যের জন্য ভারতবর্ষের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল ।
কৌটিল্যের বিবরণ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় আয়ের মুখ্য উৎস ছিল তিনটি, যথা: (ক) ভূমি রাজস্ব (খ) সামন্ত প্রভু ও জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর এবং (গ) আবগারি ও বাণিজ্য শুল্ক। ভারতবর্ষ ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষককে তার উৎপাদিত ফসলের এক- ষষ্ঠাংশ (ছয় ভাগের এক ভাগ) রাষ্ট্রকে কর হিসেবে দিতে হতাে। এ করকে বলা হতাে 'ভাগ'।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু ও মুলতান বিজয়: কারণ, ঘটনা ও ফলাফল (The Conquest of Sindh & Multan by Muhammad bin Quasim: Causes, Events & Result)
ভারতবর্ষে আরবদের প্রাথমিক সামরিক অভিযানসমূহ (Early Arab expeditions to India)মানবমুক্তির ধর্ম হিসেবে আরবভূমিতে ইসলামের পুনঃআবির্ভাবের পর মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসারী ও উত্তরাধিকারী মুসলমানগণ শান্তির ধর্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্ম ও রাজ্য বিস্তার এবং বাণিজ্য বিকাশে বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে। সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আরব মুসলমানরা বিজয় অভিযানে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে ভারতভূমিতে আরবদের বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়। সিন্ধু ও মুলতান বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। আরবদের সিন্ধু ও মুলতান বিজয় অষ্টম শতাব্দীর ঘটনা হলেও ভারতবর্ষের সাথে আরবদের যােগাযােগ বহু দিনের।
ইসলামের আবির্ভাবের অনেক পূর্ব থেকেই বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আরব বণিকেরা ভারতের উপকূলীয় বন্দর বিশেষ করে পশ্চিম উপকূলীয় বন্দরসমূহে যাতায়াত করত। তাদের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্যদ্রব্য আরব, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এমনকি ইউরােপের বাজারে পৌঁছে যেত । ইসলামের আবির্ভাবের পরও আরব মুসলিম বণিকেরা ভারতের সাথে ব্যবসা- বাণিজ্য অব্যাহত রাখে।
আরব বণিকেরা ইসলাম প্রচারে বিশেষ কোনাে তৎপরতা চালাননি সত্য, তবে তাদের যাপিত জীবন এবং তাদের সাথে আগত সুফি-দরবেশদের প্রচেষ্টায় ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ ইসলাম ধর্মের সাথে পরিচিত হয়। জাতিভেদ প্রথার নির্মম আঁতাকলে নিষ্পেষিত এবং আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় নিপীড়নে অতিষ্ঠ হিন্দুগণ।
ইসলামের সাম্য ও শান্তির বাণীতে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কোনাে কোনাে সূত্র মতে কালিকটের হিন্দু রাজা ইসলাম গ্রহন করেন।