ফাতেমি খিলাফতের পতন (Fall of the Fatimids Khilafat)

ফাতেমি খিলাফতের পতন (Fall of the Fatimids Khilafat)

ফাতেমি খিলাফত দীর্ঘ আড়াই'শ বছরেরও বেশি সময় টিকে ছিল। ১১৭১ সালে গাজী সালাউদ্দিন কর্তৃক এ খিলাফতের চূড়ান্ত পতন ঘটে। তবে এ বংশের অবক্ষয় ও ক্রমাবনতি শুরু হয়েছিল আল-হাকিমের পর থেকেই। বস্তুত ১০২১ খ্রিস্টাব্দের পর আরো প্রায় দেড়শ বছর এ বংশ টিকে থাকে। তবে এ সময়টি ছিল নিস্তরঙ্গ। এ সময় আরো ৮ জন খলিফা ফাতেমি সিংহাসন অলংকৃত করেন বটে, তবে তারা সকলেই ছিলেন নামেমাত্র শাসক। এ সময়কালে বদর আল জামালী এবং তাঁর বংশধর আর্মেনীয় উজিরদের কর্মকুশলতায় ফাতেমিনের চূড়ান্তপতন কিছুটা বিলম্বিত হয়। তবে ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি তাদের এড়ানো সম্ভব হয়নি। ঐতিহাসিকগণ ফাতেমিদের অবক্ষয়, ক্রমাবনতি ও পতনের নানাবিধ কারণ নির্দেশ করেছেন।

গাজি সালাউদ্দিন আয়ুবি

যেমন-

প্রাকৃতিক নিয়ম: ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে, একটি রাজবংশের স্বাভাবিক কর্মশক্তি ও গৌরব বড়জোর একশ বছর বজায় থাকে। এর পর শুরু হয় এর ক্রমাবনতি এবং পরিশেষে পতন। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ফাতেমিদের ক্ষেত্রেও প্রকৃতির এ স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। বস্তুত ৯০৯-১০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এদের গৌরবকাল এবং এর পরই শুরু হয় অবক্ষয় এবং ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত পতন ।

আরও পড়ুনফাতেমিগণ কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ

পরবর্তী খলিফাদের দুর্বলতা: খলিফা আল-হাকিমের মৃত্যুর পর আল-জাহির (১০২১-১০৩৫), আল-মুস্তানসির (১০৩৫ ১০৯৪), আল- মুস্তালী (১০৯৪-১১০১), আল-হাফিজ (১১৩০-১১৪৯), আল-জাফির (১১৪৯-১১৫৪), আল-ফাইল (১১৫৪-১১৬০) এবং আল-আলীদ (১১৬০-১১৭১) পর্যায়ক্রমে ফাতেমি খিলাফতের সিংহাসন অলংকৃত করেন। তবে এ ৮ জন খলিফার কেউই যোগ্য ছিলেন না। তারা ছিলেন দুর্বল অযোগ্য ও ব্যক্তিত্বহীন। তাদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার সুযোগে তাদেরকে সামনে রেখে এ সময় উজিরকুলই সাম্রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো বদর আল জামালী ও তাঁর আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত কয়েকজন উজির ছাড়া বাকি সকল উজিরই ছিলেন ক্ষমতালোভী ও স্বার্থপর। দুর্বল ও অযোগ্য খলিফা এবং স্বার্থান্ধ ও কুচক্রী মন্ত্রীদের কুশাসনের ফলে ফাতেমি খিলাফতের ক্রমাবনতি ও পতন ঘটে।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রথম পত্র
গাজি সালাউদ্দিন আয়ুবি - ফাতেমি খেলাফত পতন

অভ্যন্তরীণ গোলযোগ

তুর্কি, বার্বার ও নিগ্রোদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি বিনষ্ট হয়। এ অরাজকতার সুযোগে একের পর এক প্রদেশগুলো স্বাধীন বা হস্তচ্যুত হতে শুরু করে। ১০৪৩ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন ফাতেমিদের হস্তচ্যুত হয়। খলিফাদের ক্ষমতা কেবল মিসর ও ইফরিকিয়াতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

ইসমাঈলীয়দের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি: ফাতেমিগণ ছিলেন শিয়া ইসমাঈলীয় মতবাদে বিশ্বাসী। খলিফা আল-মুস্তানসিরের পর ইসমাঈলীয় আদর্শের সমর্থক শিয়াদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে তারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। খলিফা আল আমিরের মৃত্যুর পর একটি বড় জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রত্যাহার করে সুলাহিদ বংশ প্রতিষ্ঠা করায় ফাতেমিগণ আরো দুর্বল হয়ে পড়ে।

যোগ্য নেতৃত্বের অভাব: ফাতেমি খলিফাগণ বিশেষ করে আল-হাকিম সাম্রাজের বহুযোগ্য সামরিক ও বেসামরিক লোককে হত্যা ও ক্ষমতা থেকে অপসারণ করায় খিলাফতে যোগ্য নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয়। নেতৃত্বের এ শূন্যতা খিলাফতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শেষ পরিণামে এটি খিলাফতের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কি সেনাদের ঔদ্ধত্য: মাগরিবী বার্বারদের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য খলিফা আল-আজিজ তুর্কিদের দ্বারা একটি সেনা ইউনিট গঠন করেছিলেন। সাময়িক সময়ের জন্য এ পদক্ষেপ ফাতেমি খিলাফতের জন্য কল্যাণ বয়ে আনলেও পরে এরাই সাম্রাজ্যের জন্য নতুন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কি প্রহরী দল একসময় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয় এবং তাদের চরম ঔদ্ধত্য ফাতেমি খিলাফতে রাজনৈতিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।

অর্থনৈতিক দুর্বলতা: দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা ফাতেমি খিলাফতের অবক্ষয় ও পতনের অন্যতম কারণ ছিল। আল আজিজের পর থেকে ফতেমি খলিফাগণ আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সাফল্য দেখাতে পারেননি। ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বে পথে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

দুর্ভিক্ষ ও সালাহউদ্দিনের আক্রমণ

ফাতেমি খিলাফতের শেষদিকে কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগত দুর্ভিক্ষ দেশের আর্থিক বুনিয়াদ ভেঙে দেয়। প্রজারা করভারে জর্জরিত হয়। ক্রুসেডরদের পুনঃপুন আক্রমণে ফাতেমিদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে ক্রুসেডের কিংবদন্তি বীরযোদ্ধা গাজী সালাহউদ্দিন ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ খলিফা আল আজীদকে সিংহাসনচ্যুত করে মিসর দখল করেন। এভাবে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দু'শতাধিক বছরের পুরনো ফাতেমি বংশের অবসান ঘটে।

একক কাজ: ফাতেমি খিলাফতের পতনের কারণগুলো চিহ্নিত কর।

দলীয় কাজ: ফাতেমি খিলাফতের দুর্বল শাসকদের একটি তালিকা প্রস্তুত কর।